হিন্দু গণহত্যা

ভারত উপমহাদেশে মুসলিম আক্রমণ এবং হিন্দু গণহত্যা

প্রথম মুসলিম আক্রমণ

উমাইয়া খিলাফত ৭১২ সালে মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধ ও মুলতান দখল করারা মাধ্যমে ৮ম শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে মুসলমানদের প্রথম সংযোগ ঘটে। এটি ছিল এই অঞ্চলে ইসলামি শাসনের সূচনা। গজনভিদ সাম্রাজ্যের মাহমুদ গজনভি ১০০০ থেকে ১০২৭ সালের মধ্যে প্রধানত পাঞ্জাব ও গুজরাটের মতো ধনী অঞ্চলগুলো লক্ষ্য করে ভারতে ১৭টি অভিযান চালায়। তার অভিযানের মধ্যে ১০২৫ সালে সোমনাথ মন্দির ধ্বংস সহ অনেক উপাসনালয় ধ্বংস, লুটপাট এবং ইসলামি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই অভিযানে বহু বাসিন্দাকে হত্যা করা হয় এবং নারীদের দাসীতে পরিণত করা হয়।

দিল্লি সালতানাত

১২০৬ সালে কুতুব উদ্দিন আইবক প্রতিষ্ঠিত দিল্লি সালতানাত উত্তর ভারতে মুসলিম শাসনের সুসংহত পর্বের সূচনা করে। আলাউদ্দিন খলজি ও ফিরুজ শাহ তুঘলকের মতো শাসকেরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি যেমনঃজিজিয়া কর আরোপ প্রয়োগ করেন এবং মন্দির ধ্বংস করেন। উদাহরণস্বরূপ, ফিরুজ শাহ তুঘলক ইসলামি আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করেন এবং হিন্দু ধর্মীয় স্থানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, অন্যদিকে আলাউদ্দিন খলজির অভিযানে দেবগিরির মতো অঞ্চলে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও জোরপূর্বক ধর্মান্তর ঘটেছিল। ঐতিহাসিক দলিল, যেমন ইবনে বতুতার লেখা, দেখায় যে এই শাসনামলে সামাজিক উত্তেজনা ছিল এবং হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

মুগল সাম্রাজ্য:নিপীড়ন

১৫২৬ সালে বাবরের প্রতিষ্ঠিত মুগল সাম্রাজ্য প্রাথমিকভাবে মন্দির ধ্বংসের ধারা বজায় রাখে। এর মধ্যে অন্যতম হলও অযোধ্যার রাম মন্দির ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ নির্মাণ। তবে আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) এর শাসনামলে ধর্মীয় সহনশীলতার দিকে কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। তিনি জিজিয়া কর তুলে দেন এবং হিন্দুদের উচ্চ প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেন। এই সময়ে সংস্কৃত গ্রন্থের পৃষ্ঠপোষকতা এবং দরবারে হিন্দু উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক সংহতি দেখা যায়। বিপরীতে, আওরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭) এই নীতিগুলো উল্টে দেন, পুনরায় জিজিয়া কর আরোপ করেন এবং মথুরা ও কাশির মন্দিরসহ বহু মন্দির ধ্বংসের নির্দেশ দেন।

মন্দির ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংস

হিন্দু মন্দির ধ্বংস মুসলিম শাসনের একটি পুনরাবৃত্ত বৈশিষ্ট্য ছিল। রিচার্ড ইটনের গবেষণায় দেখা যায় যে শত্রু রাজাদের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্দিরগুলো লক্ষ্যবস্তু করা হতো, এবং দিল্লি সালতানাত ও মুগল যুগে এ ধরনের ৮০টিরও বেশি ঘটনা নথিভুক্ত রয়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞ হিন্দু রাজকীয় কর্তৃত্ব দুর্বল করার জন্য করা হতো। তবে এটি গভীর সাংস্কৃতিক প্রভাব ফেলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং হিন্দু পণ্ডিতদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

জোরপূর্বক ধর্মান্তর

বিশেষত ফিরুজ শাহ তুঘলকের মতো শাসকদের অধীনে ব্যাপকভা জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার চল প্রচলিত ছিল। এই সময়কালে জিজিয়া কর আরোপ করা হয় এবং হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়। ঐতিহাসিক বিবরণ, যেমন মুসলিম ইতিহাসবিদদের লেখায়, কাশ্মীর ও বাংলার মতো অঞ্চলে ব্যাপক ধর্মান্তরের উল্লেখ রয়েছে। যেমনঃ মৃত্যুর হুমকি বা যুদ্ধবন্দিদের ধর্মান্তরিত করা হতো।

যৌন সহিংসতা

মুসলিম আক্রমণের সময় হিন্দু নারীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার ঘটনা নথিভুক্ত রয়েছে। বিশেষত গজনভিদের আক্রমণ ও দিল্লি সালতানাত যুগে এই ঘটনা বেশি ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজয়ের সাথে সাথে হিন্দু নারীদের বন্দি করা ও ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত রয়েছে। সম্মান রক্ষার জন্য জহর প্রথার (হিন্দু নারী কর্তৃক আত্মহননের প্রাচীন অনুশীলন) প্রচলন অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে। এই ধরনের সহিংসতা প্রায়শই যুদ্ধ ও দমনমূলক কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

হিন্দু রাজাদের হত্যা ও গণহত্যা

ক্ষমতা সংহত করতে মুসলিম শাসকেরা প্রায়শই হিন্দু রাজাদের হত্যা করতেন, যেমন মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজপুত রাজ্যগুলোর প্রধানদের হত্যা করেন। গণহত্যার ঘটনা, যেমন ১৩৯৮ সালে তিমুরের দিল্লি লুণ্ঠন, হাজার হাজার হিন্দুকে হত্যা এবং সমকালীন বর্ণনায় "কাফেরদের/অবিশ্বাসীদের" লক্ষ্যবস্তু করার কথা উল্লেখ রয়েছে। মুসলিম ইতিহাসগ্রন্থগুলোতে এসব ঘটনা প্রায়ই "পবিত্র যুদ্ধ" হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।

ভারতে ইসলামে ধর্মান্তর

ভারতকে সম্পূর্ণরূপে ইসলাম গ্রহণ করাতে না পারলেও সিন্ধ, পাঞ্জাব ও বাংলা অঞ্চলে বিজয় ও অভিবাসনের মাধ্যমে ব্যাপক ইসলামিকরণ ঘটে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ফলে ঐতিহাসিক অভিবাসন ও মুসলিম জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে পাকিস্তান এবং পরে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়। আফগানিস্তান প্রাথমিক ইসলামি বিজয়ের মাধ্যমে মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রে পরিণত হয়, আর মালদ্বীপ ১২শ শতকে উত্তর আফ্রিকার এক বণিকের প্রভাবের মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করে এবং ১৯৯৭ সালের মধ্যে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়।

সংস্কৃত ও হিন্দু সংস্কৃতি ধ্বংস

মুসলিম শাসনের সময় সংস্কৃত ভাষা ও হিন্দু সংস্কৃতি নানা ঝুঁকির মুখে পড়ে; নালন্দা ও বিক্রমশিলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসের ফলে হিন্দু বিদ্বৎসমাজের পতন ঘটে। যেখানে মুসলিম শাসনের প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম ছিল যেমনঃ দক্ষিণ ভারতে সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত লোকভাষাগুলো বিকশিত হয় এবং হিন্দু সাংস্কৃতিক চর্চা বহাল থাকে।

নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বিবরণ

জাহাঙ্গীরের আদেশে গুরু অর্জন দেবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় এবং তিমুরের আক্রমণের সময় দিল্লিতে হাজার হাজার হিন্দুদের হত্যা করা হয়।

সমাপ্তি

ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের নির্দিষ্ট সময়কাল খুনি-ধর্ষক-ডাকাত মুহাম্মাদের অনুসারিদের দ্বারা হিন্দুদের ধুন, ধর্ষণ, উপাসনালয় ধ্বংস ও তাদের সম্পত্তি লুটপাট এবং সাংস্কৃতিক দমন দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।

তালিকা: সময়কাল ও ঘটনা

সময়কাল ঘটনা হিন্দুদের উপর প্রভাব
৮ম শতাব্দি উমাইয়াদের সিন্ধু দখল মুসলিম শাসন, জোরপূর্বক ধর্মান্তর
১০ম-১১শ শতাব্দী গজনভিদের অভিযান (গজনীর মাহমুদ) মন্দির ধ্বংস, গণহত্যা
১২০৬-১৫২৬ দিল্লি সুলতান সুলতানি জিজিয়া আরোপ, মন্দির অপবিত্রকরণ
১৯৪৭ ভারত বিভাজন পাকিস্তান, বাংলাদেশ সৃষ্টি ও সেখানকার হিন্দুদের উপর সহিংসতা

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম আক্রমণ ও হিন্দু গণহত্যা

মন্তব্যসমূহ