শিব

শিব (शिव, অর্থ 'মঙ্গলময়')/ মহাদেব (महादेव:, অর্থ 'মহাদেবতা')/ হর হিন্দু ধর্মের প্রধান দেবতাদের একজন। হিন্দু ধর্মের প্রধান ধারাগুলির মধ্যে একটি, শৈব ধর্মে তিনি সর্বোচ্চ সত্তা। ত্রিমূর্তিতে শিবকে ধ্বংসকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শৈব প্রথায় শিব হলেন সর্বোচ্চ প্রভু। তিনি বিশ্ব সৃষ্টি করেন, রক্ষা করেন এবং রূপান্তরিত করেন। দেবী-ভিত্তিক শাক্ত প্রথায়, সর্বোচ্চ দেবী শক্তি এবং সৃজনশীল শক্তি হিসেবে বিবেচিত হন এবং তিনি শিবের সমান ও পরিপূরক সঙ্গী। শিব হিন্দু ধর্মের স্মার্ত প্রথার পঞ্চায়তন পূজার পাঁচ সমান দেবতার একজন।

শিবের বহু দিক রয়েছে— মঙ্গলময় এবং ভয়ংকর। মঙ্গলময় রূপে, তাঁকে সর্বজ্ঞ যোগী হিসেবে চিত্রিত করা হয়। তিনি কৈলাসে তপস্বী জীবনযাপন করেন, পাশাপাশি গৃহস্থ রূপে তাঁর স্ত্রী পার্বতী এবং দুই সন্তান গণেশ ও কার্তিকেয়ের সঙ্গে বসবাস করেন। ভয়ংকর রূপে, শিবকে প্রায়শই অসুরবধ করতে দেখা যায়। শিব আদিযোগী নামেও পরিচিত এবং তাঁকে যোগ, ধ্যান এবং শিল্পকলার অধিষ্ঠাতা দেবতা হিসেবে গণ্য করা হয়।

শিবের প্রতীকী বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে গলায় সর্পরাজ বাসুকি, শোভা বর্ধনকারী অর্ধচন্দ্র, জটাজুট থেকে প্রবাহিত পবিত্র গঙ্গা নদী, কপালে তৃতীয় নয়ন, অস্ত্র হিসেবে ত্রিশূল এবং ডমরু। সাধারণত তাঁকে নিরাকার লিঙ্গরূপে পূজা করা হয়।

শিবের রূপটি বিভিন্ন প্রাচীন অবৈদিক ও বৈদিক যেমনঃ ঋগ্বেদীয় ঝড়ের দেবতা রুদ্র এর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। এভাবে শিব একক প্রধান দেবতায় রূপান্তরিত হন। শিব হলেন সর্বহিন্দু দেবতা এবং ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং ইন্দোনেশিয়া (বিশেষত জাভা ও বালি দ্বীপে) হিন্দুরা ব্যাপকভাবে পূজা করেন।

উৎপত্তি ও অন্যান্য নাম

মনের-উইলিয়ামস সংস্কৃত অভিধান অনুসারে, "শিব" শব্দটির অর্থ হলো "মঙ্গলময়, শুভ, কৃপাময়, দয়ালু, কল্যাণকর, সদয়, বন্ধুত্বপূর্ণ"। শিব শব্দের লোকপ্রচলিত ব্যুৎপত্তি অনুসারে এর মূল অংশ হলো "শী", যার অর্থ "যাঁর মধ্যে সমস্ত কিছু অবস্থান করে, সর্বব্যাপকতা" এবং "ব" যার অর্থ "অনুগ্রহের মূর্তি"।

ঋগ্বেদে (প্রায় ১৭০০–১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) "শিব" শব্দটি একটি বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এটি রুদ্রসহ বেশ কয়েকজন ঋগ্বেদীয় দেবতার জন্য বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। শিব শব্দটি "মুক্তি, চূড়ান্ত মোক্ষ" এবং "মঙ্গলময়" অর্থেও ব্যবহৃত হয়; বৈদিক সাহিত্যেও এই বিশেষণটি বহু দেবতার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটি বৈদিক রুদ্র-শিব থেকে মহাকাব্য এবং পুরাণে রূপান্তরিত হয়ে শিব নামক "সৃষ্টি, প্রজনন এবং সংহারকারী" এক মঙ্গলময় দেবতায় পরিণত হয়েছেন। 

শর্মা আরেকটি ব্যুৎপত্তি উল্লেখ করেছেন, যেখানে সংস্কৃত মূল শব্দ "শার্ব্" (śarv-) এর অর্থ হলো "আঘাত করা" বা "বিনাশ করা"। এর ভিত্তিতে শিব শব্দের অর্থ দাঁড়ায় "যিনি অন্ধকারের শক্তিকে বিনাশ করতে সক্ষম"।

সংস্কৃত শব্দ "শৈব" (śaiva) এর অর্থ হলো "শিবের সাথে সম্পর্কিত" এবং এই শব্দটি হিন্দু ধর্মের প্রধান সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একটির এবং সেই সম্প্রদায়ের অনুসারীদের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি বিশেষণ হিসেবে শৈবধর্মের নির্দিষ্ট বিশ্বাস ও আচরণগুলিকে বর্ণনা করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

কিছু লেখক শিব নামটিকে তামিল শব্দ śivappu এর সাথে সম্পর্ক আছে বলে উল্লেখ করেছেন। śivappu র অর্থ "লাল", উল্লেখ করে যে শিব সূর্যের সাথে যুক্ত (তামিলে śivan, অর্থ "লাল রঙের"), এবং ঋগ্বেদে রুদ্রকেও বভ্রু (বাদামী বা লাল) নামে ডাকা হয়েছে।

বিষ্ণু সহস্রনামে শিব শব্দের একাধিক অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে: "বিশুদ্ধ সত্তা" এবং "তিনি যিনি প্রকৃতির তিনটি গুণ—সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ দ্বারা প্রভাবিত নন"। 

শিবের বহু নাম রয়েছে, যেমন বিশ্বনাথ, মহাদেব, মহানদেও, মহাসু, মহেশ, মহেশ্বর, শঙ্কর, শম্ভু, রুদ্র, হর, ত্রিলোচন, দেবেন্দ্র, নীলকণ্ঠ, শুভঙ্কর, ত্রিলোকনাথ এবং ঘৃণেশ্বর। শৈব ধর্মে শিবের সর্বোচ্চ গৌরব তাঁর বিশেষণগুলির মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়, যেমন মহাদেব ("মহান দেবতা", মহেশ্বর ("মহান প্রভু"), এবং পরমেশ্বর ("সর্বোচ্চ প্রভু")।

কোনো দেবতার বিভিন্ন দিক এবং বিশেষণ থেকে উদ্ভূত এক হাজার নামের তালিকা মধ্যযুগীয় ভারতীয় গ্রন্থসমূহকে সহস্রনামা বলে। ভক্তিগীত (স্তোত্র) আকারে শিবের বহু নামকে তালিকাভুক্ত করা শিব সহস্রনামার অন্তত আটটি ভিন্ন সংস্করণ রয়েছে। এর একটি তালিকা মহাভারতের ত্রয়োদশ পুস্তক (অনুশাসন পর্ব)-এ পাওয়া যায়। শিবের দশ-সহস্রনামা (দশ হাজার নাম) মহান্যাসে গ্রন্থে পাওয়া যায়। শ্রী রুদ্রম চমকম (শতরুদ্রীয় নামেও পরিচিত) শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি ভক্তিগীত। রুদ্রম চমকম  -এ তাঁকে বহু নামে বন্দনা করা হয়েছে।

ঐতিহাসিক বিকাশ ও সাহিত্য

প্রথার সমন্বয়

সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে যেমন ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বালি, ইন্দোনেশিয়ার মতো স্থানে শিব-সংক্রান্ত প্রথা হিন্দু ধর্মের একটি প্রধান অংশ। শিবের যে রূপটি বর্তমানে পরিচিত, তা হল সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়া এবং বৈদিক-পরবর্তী সময়ে হিন্দু ধর্মের সমন্বয়মূলক বিকাশের ফলে বিভিন্ন প্রাচীন দেবতার একীভূত রূপ। শিবের ব্যক্তিত্ব কীভাবে এক সমন্বিত দেবতা হিসেবে গড়ে উঠেছে, তার সঠিক বিবরণ সুস্পষ্ট নয়; এটি খুঁজে বের করা কঠিন এবং এ বিষয়ে বহু জল্পনা-কল্পনা রয়েছে।

বিজয় নাথের মতে:
"বিষ্ণু এবং শিব [...] অসংখ্য স্থানীয় উপাসনা এবং দেবতাদের নিজেদের মধ্যে শোষিত করতে শুরু করেন। এই স্থানীয় দেবতারা হয় একই দেবতার বিভিন্ন দিক হিসেবে গণ্য হতেন অথবা বিভিন্ন রূপ ও উপাধি হিসেবে পরিচিত হয়ে পূজিত হতেন। [...] স্থানীয় দেবতার নামের শেষে 'ঈশ' বা 'ঈশ্বর' যুক্ত করার মাধ্যমে শিব অসংখ্য স্থানীয় উপাসনার সাথে একীভূত হন, যেমন ভুতেশ্বর, হাটকেশ্বর, চন্ডেশ্বর।"

মহারাষ্ট্রে প্রথার সমন্বয়ের একটি উদাহরণ দেখা যায়, যেখানে খান্ডোবা নামক এক স্থানীয় দেবতা কৃষক এবং পশুপালক সম্প্রদায়ের রক্ষাকর্তা। মহারাষ্ট্রে খান্ডোবার প্রধান উপাসনাকেন্দ্রটি জেজুরিতে অবস্থিত। খান্ডোবাকে স্বয়ং শিবের এক রূপ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে এবং এই রূপে তাঁকে লিঙ্গমূর্তির আকারে পূজা করা হয়। খান্ডোবার অন্যান্য সম্পর্কগুলির মধ্যে রয়েছে সূর্য ও কার্ত্তিকেয়ের সাথে সাদৃশ্য।

খ্রিস্টধর্মের প্রাথমিক যুগের সমসাময়িক সময়ে শিব সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিনিগুলি প্রচলিত ছিল, যেখানে শিবকে এখনকার ধারণার তুলনায় অনেক ভিন্নভাবে চিত্রিত করা হয়েছিল। শিবের এই পৌরাণিক রূপগুলি পরবর্তী যুগে তাঁর চরিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, সেই সময়ে শিব এবং অন্যান্য দেবতাদের—উচ্চতম থেকে ক্ষুদ্রতম দেবতা পর্যন্ত—মানবীয় প্রকৃতির অধিকারী বলে বিবেচনা করা হতো। তাঁদের আবেগ ছিল, যা তাঁরা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। তবে তপস্যার মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের অন্তর্নিহিত প্রকৃতির সাথে সংযুক্ত হতে পারতেন, যেমনটি মানুষও করতে পারে। সেই যুগে শিবকে কামনা এবং তপস্যা উভয়ের দেবতা হিসেবে দেখা হতো। এক কাহিনিতে বলা হয়েছে যে, অন্য দেবতারা শিবের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে প্রলুব্ধ করার জন্য এক পতিতাকে পাঠিয়েছিলেন, কারণ শিব এক হাজার বছর ধরে কঠোর তপস্যার জীবন যাপন করছিলেন।

বৈদিক যুগের পূর্বের উপাদানসমূহ

প্রত্নপ্রস্তর শিল্পকলা

ভীমবেটকার গুহাচিত্রগুলির মেসোলিথিক যুগের শিলা চিত্রসমূহকে কিছু লেখক শিবের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে, হাওয়ার্ড মর্ফি বলেছেন যে ভারতের এই প্রাগৈতিহাসিক শিলা চিত্রগুলি প্রেক্ষাপটসহ বিবেচনা করলে, সেগুলি সম্ভবত পশু সহ শিকার দলের চিত্রণ এবং একত্রে নৃত্যরত ব্যক্তিদের ছবি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

সিন্ধু সভ্যতা এবং পশুপতি সীলমোহর

সিন্ধু সভ্যতার বহু সীলমোহরের মধ্যে পশু চিত্রিত করা হয়েছে, তবে যে সীলমোহরটি বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, সেটির কেন্দ্রে একটি বড় মূর্তি দেখা যায়, যা হয় শিংযুক্ত বা শিংযুক্ত মুকুট পরিধান করে আছে এবং সম্ভবত ইথিফ্যালিক অবস্থায় রয়েছে। এই মূর্তিটি পদ্মাসনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ভঙ্গিতে বসে রয়েছে এবং চারপাশে বিভিন্ন প্রাণী দ্বারা পরিবেষ্টিত। মহেঞ্জোদারোর প্রাথমিক খননকারীরা এই মূর্তিটিকে পরবর্তী হিন্দু দেবতা শিব এবং রুদ্রের একটি উপাধি,পশুপতি নামে অভিহিত করেছিলেন।

স্যার জন মার্শাল এবং অন্যান্যরা এই মূর্তিটিকে শিবের আদি রূপ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। মূর্তিটি তিন-মুখযুক্ত এবং তিনি "যোগাসন" ভঙ্গিতে বসে আছেন—যেখানে হাঁটু দুটি বাহিরের দিকে এবং পা দুটি সংযুক্ত। মাথার অর্ধবৃত্তাকার আকারগুলিকে দুটি শিং হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। তবে গ্যাভিন ফ্লাড, জন কে এবং ডরিস মেথ শ্রীনিবাসনের মতো পণ্ডিতরা এই ব্যাখ্যার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

গ্যাভিন ফ্লাড উল্লেখ করেছেন যে সীলমোহর থেকে স্পষ্ট নয় যে মূর্তিটির তিনটি মুখ রয়েছে, এটি যোগাসনে বসে আছে বা এটি মানব আকৃতি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে। তিনি এই মতগুলোকে "অনুমাননির্ভর" বলে বর্ণনা করেছেন, তবে যোগ করেছেন যে, তবুও এতে শৈব মূর্তিতাত্ত্বিক থিমগুলির প্রতিধ্বনি থাকতে পারে, যেমন ষাঁড়ের শিংয়ের মতো অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকার।

জন কে লিখেছেন যে, "তিনি সত্যিই পশুপতি রূপে ভগবান শিবের প্রাথমিক প্রকাশ হতে পারেন," তবে এই মূর্তির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রুদ্রের সাথে মেলে না। ১৯৯৭ সালে লেখা এক নিবন্ধে শ্রীনিবাসন জন মার্শালের ব্যাখ্যায় যে মুখাবয়বের কথা বলা হয়েছে, তা মানবীয় নয় বরং গবাদি পশুর মতো, যা সম্ভবত এক দেবতাস্বরূপ মহিষমানব।

এই সীলমোহরের ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। উদাহরণস্বরূপ, ম্যাকএভিলি বলেছেন যে, "যোগিক ব্যাখ্যা বাদে এই ভঙ্গির ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়"। আসকো পার্পোলা উল্লেখ করেছেন যে অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার, যেমন ৩০০০–২৭৫০ খ্রিস্টপূর্বের প্রাচীন এলামাইট সীলমোহরগুলিতে অনুরূপ মূর্তি দেখা যায় এবং এগুলিকে "বসে থাকা মহিষ" হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যা যোগির চেয়ে বেশি সঠিক ব্যাখ্যা হতে পারে।

গ্রেগরি এল. পসেল ২০০২ সালে এই মূর্তিটিকে জল মহিষের সাথে যুক্ত করেছিলেন এবং উপসংহার টেনেছেন যে, মূর্তিটিকে দেবতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং এর ভঙ্গিমাকে এক ধরনের আচারিক শৃঙ্খলা হিসেবে গণ্য করা যথাযথ হবে, তবে এটিকে শিবের আদি রূপ হিসেবে বিবেচনা করা "খুব দূরবর্তী অনুমান" হবে।

প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় উপাদানসমূহ

প্রাক-শাস্ত্রীয় যুগের বৈদিক বিশ্বাস ও প্রথাগুলি অনুমানকৃত প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় ধর্ম এবং ইসলাম-পূর্ব ইন্দো-ইরানীয় ধর্মের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিল। শিবের মূর্তিতত্ত্ব এবং ধর্মতত্ত্বের সাথে গ্রিক এবং ইউরোপীয় দেবতাদের সাদৃশ্যের কারণে শিবের জন্য ইন্দো-ইউরোপীয় যোগসূত্রের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে অথবা প্রাচীন মধ্য এশীয় সংস্কৃতির সাথে পার্শ্ববর্তী বিনিময়ের ধারণা দেওয়া হয়েছে।

তাঁর বিপরীত বৈশিষ্ট্যসমূহ যেমন পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে কখনো ভয়ঙ্কর, কখনো আনন্দময় হয়ে ওঠা, গ্রিক দেবতা ডায়োনিসাসের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। তদ্রূপ, ষাঁড়, সাপ, ক্রোধ, সাহসিকতা, নৃত্য এবং নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের সাথে তাঁদের প্রতীকী সংযোগও একরকম। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সময়কার প্রাচীন গ্রিক গ্রন্থগুলোতে শিবকে "ভারতীয় ডায়োনিসাস" নামে অভিহিত করা হয়েছে অথবা ডায়োনিসাসকে "প্রাচ্যের দেবতা" বলা হয়েছে।

তদ্রূপভাবে, শিবের প্রতীক হিসেবে লিঙ্গের ব্যবহার আয়ারল্যান্ড, নর্ডিক অঞ্চল, গ্রিক (ডায়োনিসাস), এবং রোমান দেবতাদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। রজার উডওয়ার্ড বলেছেন, আদি ইন্দো-আর্যদের মধ্যে স্বর্গ এবং পৃথিবীকে সংযুক্তকারী নিরাকার স্তম্ভের ধারণাটিও ছিল। তবে অন্যরা এই প্রস্তাবগুলোর বিরোধিতা করেছেন এবং শিবকে আর্য-পূর্ব উপজাতীয় উৎস থেকে উদ্ভূত বলে মত প্রকাশ করেছেন।

রুদ্র

আমরা যেভাবে শিবকে চিনি, তিনি বৈদিক দেবতা রুদ্রের সাথে অনেক বৈশিষ্ট্যর মিল রয়েছে, এবং হিন্দু ধর্মগ্রন্থে শিব ও রুদ্রকে একই ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই দুটি নাম সমার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়। রুদ্র ঋগ্বেদীয় দেবতা এবং ভয়ঙ্কর শক্তির অধিকারী, ছিলেন গর্জনকারী ঝড়ের দেবতা। সাধারণত তাঁকে সেই উপাদানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চিত্রিত করা হয় যা তিনি উপস্থাপন করেন—একজন ভয়ঙ্কর ও ধ্বংসাত্মক দেবতা হিসেবে।

ঋগ্বেদ ২.৩৩-এ তাঁকে ঝড়ের দেবতাদের একটি গোষ্ঠী "রুদ্রদের পিতা" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ফ্লাড উল্লেখ করেছেন যে রুদ্র ছিলেন একটি অস্পষ্ট দেবতা। তিনি বৈদিক দেবতাদের প্যান্থিয়নের প্রান্তে অবস্থান করতেন, যা সম্ভবত তাঁর অবৈদিক উৎসের ইঙ্গিত দেয়। তবুও, রুদ্র এবং শিব উভয়েই জার্মানিক দেবতা উডানের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যিনি রাগ ("wütte") এবং বন্য শিকারের দেবতা হিসেবে পরিচিত।

সদাশিবনের মতে, হিন্দু ধর্মের সমন্বয় প্রক্রিয়ার সময়, ব্রাহ্মণরা বুদ্ধের বৈশিষ্ট্যগুলো শিবের মধ্যে স্থানান্তরিত করেছিলেন, যিনি রুদ্রের সাথেও সংযুক্ত ছিলেন। ঋগ্বেদে রুদ্রকে উত্সর্গীকৃত ১,০২৮টি স্তোত্রের মধ্যে তিনটি স্তোত্র রয়েছে এবং অন্যান্য স্তোত্রেও তাঁকে মাঝে মাঝে উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগ্বেদ ১০.৯২ স্তোত্রে বলা হয়েছে যে দেবতা রুদ্রের দুটি স্বভাব রয়েছে: একটি বন্য এবং নির্মম (রুদ্র), এবং অন্যটি দয়ালু ও শান্ত (শিব)।

'শিব' শব্দটি কেবল একটি উপাধি হিসেবেও দেখা যায়, যার অর্থ হলো "দয়ালু, মঙ্গলময়"—এটি বহু ভিন্ন বৈদিক দেবতার বর্ণনায় ব্যবহৃত বিশেষণগুলোর মধ্যে একটি। ঋগ্বেদের স্তোত্রগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ঝড়ের সাথে সম্পর্কিত ভয়ঙ্কর ও নির্মম রুদ্রকে ভয় করা হলেও, তিনি যে কল্যাণকর বৃষ্টি বর্ষণ করেন, তা তাঁর শিব রূপ হিসেবে স্বাগত জানানো হয়। এই নিরাময়কারী, পোষণকারী এবং জীবনদায়ক দিকটি বৈদিক গ্রন্থে রুদ্র-শিবা রূপে উদ্ভাসিত হয় এবং উত্তর-বৈদিক সাহিত্যতে শিব রূপে পরিণত হয়, যিনি বিধ্বংসী ও সৃষ্টিশীল শক্তিকে একত্রিত করে ভয়ঙ্কর ও কোমল রূপকে সমন্বিত করেছেন—তিনি হলেন সমগ্র সত্তার সর্বশেষ পুনঃপ্রচলক এবং পুনর্জীবন দানকারী।

বৈদিক গ্রন্থগুলোতে রুদ্র বা অন্য কোনো দেবতার বাহন হিসেবে ষাঁড় বা কোনো পশুর উল্লেখ নেই। তবে উত্তর-বৈদিক গ্রন্থ যেমন মহাভারত ও পুরাণগুলোতে নন্দী ষাঁড়, বিশেষত ভারতীয় জেবু গরুকে রুদ্র এবং শিবের বাহন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

অগ্নি

রুদ্র এবং অগ্নির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে অগ্নি এবং রুদ্রের অভিন্নতা রুদ্রের ধীরে ধীরে রুদ্র-শিবতে রূপান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। ব্যুৎপত্তি বিষয়ক একটি প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, নিরুক্ত এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে: "অগ্নিকেও রুদ্র বলা হয়।" উভয় দেবতার পারস্পরিক সংযোগ জটিল, এবং স্টেলা ক্রামরিশের মতে:

"রুদ্র-শিবের অগ্নি-মিথ সমস্ত ধরনের অগ্নির গুণাবলী এবং পর্যায়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে, দাহ থেকে আলোকসজ্জা পর্যন্ত সমস্ত সম্ভাবনাকে মূল্যায়ন করে।"

শতরুদ্রীয়তে রুদ্রের কিছু উপাধি, যেমন শশিপাঞ্জর ("শিখার মতো সুবর্ণ লালবর্ণ") এবং তিবষীমতী ("উজ্জ্বল জ্বলন্ত"), এই দুই দেবতার সংমিশ্রণের ইঙ্গিত দেয়। অগ্নিকে ষাঁড় বলা হয়েছে, এবং শিবের বাহনও হলো ষাঁড়, নন্দী। অগ্নির শৃঙ্গ বা শিংয়ের উল্লেখ রয়েছে, যাকে কখনো কখনো ষাঁড় হিসেবে বর্ণনা করা হয়। মধ্যযুগীয় ভাস্কর্যে, অগ্নি এবং ভৈরব রূপের শিব উভয়েরই অগ্নিশিখার মতো জ্বলন্ত কেশ বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা যায়।

ইন্দ্র

ওয়েন্ডি ডনিগারের মতে, শৈব উর্বরতার মিথ এবং শিবের কিছু লিঙ্গসংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য ইন্দ্রের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। ডনিগার তার ধারণার পক্ষে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। উভয়েই পর্বত, নদী, পুরুষ উর্বরতা, তেজস্বিতা, নির্ভীকতা, যুদ্ধ, প্রতিষ্ঠিত নীতিমালার লঙ্ঘন, ওঁ ধ্বনি এবং সর্বোচ্চ আত্মার সাথে সম্পর্কিত। ঋগ্বেদে শিব শব্দটি ইন্দ্রকে নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়েছে (২.২০.৩, ৬.৪৫.১৭, এবং ৮.৯৩.৩)। ইন্দ্র, শিবের মতোই, ষাঁড়ের সাথে তুলনীয়। ঋগ্বেদে রুদ্রকে মরুতদের পিতা বলা হয়েছে, তবে যুদ্ধ সংক্রান্ত কৃতিত্বের ক্ষেত্রে তিনি কখনো ইন্দ্রের মতো জড়িত নন।

ইন্দ্রকে সম্ভবত বৈদিক আর্যরা বাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানা সংস্কৃতি থেকে গ্রহণ করেছিল। অ্যান্থনির মতে:

"ইন্দো-ইরানীয় শক্তি ও বিজয়ের দেবতা ভেরেথ্রাঘ্নার বহু বৈশিষ্ট্য গৃহীত হয়ে ইন্দ্রের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল, যিনি ক্রমবর্ধমান প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। ইন্দ্রকে নিয়ে ঋগ্বেদে ২৫০টি সূক্ত রচিত হয়েছে, যা মোট সূক্তের এক চতুর্থাংশ। অন্য যেকোনো দেবতার চেয়ে ইন্দ্রের সাথে সোমের সম্পর্ক বেশি—এটি একটি উদ্দীপক মাদক (সম্ভবত এফেড্রা থেকে প্রাপ্ত), যা সম্ভবত বাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানা সংস্কৃতি থেকে গৃহীত হয়েছিল। তাঁর প্রাধান্যে উন্নীত হওয়া প্রাচীন ভারতীয় ভাষাভাষীদের সংস্কৃতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল।"

জৈন ধর্মের গ্রন্থ এবং শিল্পকর্মে ইন্দ্রকে একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে দেখানো হয়েছে, যদিও তিনি পুরোপুরি একই নন, তবে হিন্দু ধর্মে পাওয়া নৃত্যরত শিবের শিল্পকর্মের সাথে বিশেষত তাদের নিজ নিজ মুদ্রায় সাদৃশ্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এলোরার জৈন গুহাগুলিতে বিস্তৃত খোদাইচিত্রে তীর্থঙ্করদের প্রতিমার পাশে নটরাজ রূপী শিবের অনুরূপ, নৃত্যরত ইন্দ্রকে চিত্রিত করা হয়েছে। নৃত্যের প্রতিমূর্তিতে এই সাদৃশ্য ইন্দ্র এবং শিবের মধ্যে একটি প্রাচীন যোগসূত্রের ইঙ্গিত দেয়।

বিকাশ

আত্ম-উপলব্ধি এবং শৈব উপনিষদ

যিনি সকল প্রাণীর মধ্যে নিজেকে দেখেন,
এবং সকল প্রাণীকে নিজের মধ্যে দেখেন,
তিনিই পরম ব্রহ্মকে লাভ করেন,
অন্য কোনো উপায়ে নয়।

—কৈবল্য উপনিষদ 


কিছু গ্রন্থ যেমন অথর্বশিরাস উপনিষদ রুদ্রের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে সমস্ত দেবতা রুদ্র, প্রত্যেক মানুষ এবং প্রতিটি বস্তু রুদ্র, এবং রুদ্রই সমস্ত জিনিসের মধ্যে বিরাজমান নীতি, তাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য এবং সকল দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বাস্তবতার অন্তঃস্থ সারসত্তা।

জার্মান ভারততত্ত্ববিদ এবং দর্শনের অধ্যাপক পল ডয়েসেন ব্যাখ্যা করেছেন যে, কৈবল্য উপনিষদও অনুরূপভাবে বলে আত্ম-উপলব্ধ ব্যক্তি হলেন যিনি নিজেকে কেবল সমস্ত জীবের মধ্যে বিদ্যমান ঐশ্বরিক সারসত্তা হিসেবে অনুভব করেন, যিনি নিজের এবং সকলের চেতনাকে শিব (সর্বোচ্চ আত্মা) হিসেবে অনুভব করেন, এবং যিনি এই সর্বোচ্চ আত্মাকে নিজের অন্তরের গভীরে আবিষ্কার করেছেন।

গ্যাভিন ফ্লাডের মতে, রুদ্রের ক্ষুদ্র বৈদিক দেবতা থেকে সর্বোচ্চ সত্তায় রূপান্তরের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০–২০০), যা রুদ্র-শিবের প্রতি ভক্তির প্রাথমিক বীজ উপস্থাপন করে। এখানে রুদ্র-শিবকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা এবং আত্মাকে জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তিদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ প্রাথমিক শৈব চিন্তার ভিত্তি স্থাপন করে, বিশেষত তৃতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় শ্লোকে, যেখানে শিবকে ব্রহ্মনের সমতুল্য বলা হয়েছে: "রুদ্র সত্যিই এক; কারণ ব্রহ্মজ্ঞানীরা দ্বিতীয় সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।"

খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিস্টাব্দ ১০০ সালের সময়কাল শিবপূজা কেন্দ্রিক শৈব ঐতিহ্যের সূচনাকাল হিসেবে চিহ্নিত (ঐ সময়ের অন্যান্য সাহিত্যে প্রমাণিত)। অন্য পণ্ডিত যেমন রবার্ট হিউম এবং ডরিস শ্রীনিবাসন মনে করেন যে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ কেবল শিববাদ নয়, বরং বহুত্ববাদ, সর্বেশ্বরবাদ উপস্থাপন করে।

শৈব ভক্ত ও তপস্বীদের উল্লেখ পাওয়া যায় পতঞ্জলির মহাভাষ্যে (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী) এবং মহাভারতে।

শিবের প্রাচীনতম প্রতিমূলক শিল্পকর্মগুলি সম্ভবত গন্ধারা এবং প্রাচীন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে পাওয়া যেতে পারে। তবে এ বিষয়ে কিছু অনিশ্চয়তা রয়েছে, কারণ সংরক্ষিত শিল্পকর্মগুলি ক্ষতিগ্রস্ত এবং সেগুলিতে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ সম্পর্কিত শিল্পের সাথে কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে। তবে এই শিল্পকর্মে শিবের ত্রিশূল এবং লিঙ্গ প্রতীকের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে এটি সম্ভবত শিবেরই চিত্রণ।

মুদ্রাতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রাচীন কুষাণ সাম্রাজ্যের (৩০–৩৭৫ খ্রিস্টাব্দ) অসংখ্য মুদ্রায় এক দেবতার ছবি রয়েছে, যিনি সম্ভবত শিব। কুষাণ মুদ্রায় শিবকে অজানা ব্যুৎপত্তি এবং উৎসবিশিষ্ট "ওয়েশো" নামে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কুষাণ যুগের শিল্পকর্মে ইন্দ্র এবং শিবের যুগপৎ উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে কুষাণ সাম্রাজ্যের সূচনালগ্নেই তারা পূজিত দেবতা ছিলেন।

শৈব উপনিষদসমূহ হল হিন্দু ধর্মের ১৪টি ক্ষুদ্র উপনিষদের একটি গুচ্ছ, যেগুলির রচনাকাল প্রথম সহস্রাব্দ খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষ শতক থেকে শুরু করে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নির্ধারিত হয়েছে। এই উপনিষদগুলি শিবকে অপরিবর্তনীয় তাত্ত্বিক বাস্তবতা ব্রহ্ম এবং আত্মা (স্বয়ং) হিসেবে বর্ণনা করে এবং শিব সম্পর্কিত আচার-অনুষ্ঠান ও প্রতীকবাদের বিষয়ে বিবিধ অংশ অন্তর্ভুক্ত করে।

শৈব পুরাণসমূহে, বিশেষত শিব পুরাণ এবং লিঙ্গ পুরাণে, শিবের বিভিন্ন দিক, পুরাণকথা, বিশ্বতত্ত্ব এবং তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত তীর্থযাত্রার উল্লেখ রয়েছে । অষ্টম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত শিব সম্পর্কিত তন্ত্র সাহিত্যগুলো ভক্তিমূলক দ্বৈত শৈবধর্মে শ্রুতি হিসেবে গণ্য হয়। প্রতিটি জীবিত সত্তার অন্তরে অবস্থিত আত্মা এবং শিবকে দুটি পৃথক বাস্তবতা (দ্বৈতবাদ, দ্বৈত) হিসেবে বিবেচনা করা দ্বৈত শৈব আগমসমূহ শৈব সিদ্ধান্তের মূল গ্রন্থ।

অন্যান্য শৈব আগমসমূহ শিক্ষা দেয় যে এই দুই সত্তা একই বাস্তবতা (অদ্বৈতবাদ, অদ্বৈত), এবং শিব হলেন আত্মা, প্রতিটি জীবিত সত্তার মধ্যে বিদ্যমান পরিপূর্ণতা ও সত্য। শিব সম্পর্কিত উপ-প্রচলিতিতে দশটি দ্বৈত আগম গ্রন্থ, আঠারোটি যোগ্য অদ্বৈত ও দ্বৈত আগম গ্রন্থ এবং চৌষট্টিটি অদ্বৈত আগম গ্রন্থ রয়েছে।

শিব সম্পর্কিত সাহিত্য খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দ থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সমগ্র ভারতে বিশেষভাবে কাশ্মীর এবং তামিল শৈব ঐতিহ্যে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যেই শৈবধর্ম তামিলকামে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে, যেখানে আপ্পার এবং সাম্বন্দর প্রভৃতি কবিগণ সমৃদ্ধ কাব্য রচনা করেন, যা শিবের সঙ্গে সম্পর্কিত বর্তমান বৈশিষ্ট্যগুলিতে পূর্ণ। যেমন, তাঁর তাণ্ডব নৃত্য, মৃদঙ্গ (ডমরু), অগ্নি ধারণ করার রূপ এবং তাঁর জটায় গঙ্গার গর্বিত প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার দিক।

অদ্বৈত শিব সাহিত্য সর্বাত্মক একত্বের ধারণা প্রচার করে, অর্থাৎ শিব প্রত্যেক নারী ও পুরুষের মধ্যে বিরাজমান, শিব প্রত্যেক জীবিত সত্তার মধ্যে অবস্থিত, শিব বিশ্বজুড়ে প্রতিটি জড় বস্তুতেও উপস্থিত এবং জীবন, পদার্থ, মানুষ এবং শিবের মধ্যে কোনো আধ্যাত্মিক পার্থক্য নেই। মধ্যযুগীয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিভিন্ন দ্বৈত এবং অদ্বৈত শিবসংক্রান্ত ধারণাগুলিকে সাদরে গ্রহণ করা হয়, যা ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ায় অসংখ্য শিব মন্দির, শিল্পকর্ম এবং গ্রন্থের প্রেরণাস্বরূপ হয়, যেখানে স্থানীয় পূর্ব-বিদ্যমান ধর্মতত্ত্বের সাথে সমন্বিত একীকরণ লক্ষ্য করা যায়।

হিন্দুধর্মে অবস্থান

শৈবধর্ম

শৈবধর্ম হিন্দুধর্মের চারটি প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি, অন্যগুলো হলো বৈষ্ণবধর্ম, শক্তিধর্ম এবং স্মার্ত সম্প্রদায়। শৈবধর্মের অনুসারীরাদের "শৈব" বলা হয় এবং তারা শিবকে সর্বোচ্চ সত্তা হিসেবে পূজা করে। শৈবদের বিশ্বাস যে শিবই সর্বকিছু এবং সর্বত্র আছেন; তিনি সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, বিনাশকারী, প্রকাশকারী এবং গোপনকারী। তিনি শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তা নন, বরং তার থেকেই সৃষ্টি উৎপন্ন হয়; তিনি সর্বত্র এবং সর্বকিছু। শৈব ঐতিহ্যে শিব হলেন আদি আত্মা, শুদ্ধ চেতন ও চূড়ান্ত বাস্তবতা। শিব 'ওঁ' (ॐ)-এর অংশ, যেখানে তিনি 'উ' (उ)।

শৈব ধর্মতত্ত্বকে সাধারণত দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়: বৈদিক, মহাকাব্য এবং পুরাণে শিব-রুদ্র দ্বারা প্রভাবিত জনপ্রিয় ধর্মতত্ত্ব এবং শিব ও শক্তি সম্পর্কিত তন্ত্র পাঠ দ্বারা প্রভাবিত গুপ্ত ধর্মতত্ত্ব। বৈদিক-ব্রাহ্মণিক শিব ধর্মতত্ত্বে দ্বৈতবাদী (দ্বৈত) এবং অদ্বৈতবাদী (অদ্বৈত) উভয় ঐতিহ্য বিদ্যমান, যেমন তামিল শৈব সিদ্ধান্ত এবং লিঙ্গায়ত ধর্ম। শিব মন্দিরে লিঙ্গ, শিব-পার্বতী মূর্তি, মন্দির চত্বরে ষাঁড় নন্দীর উপস্থিতি এবং শিবের বিভিন্ন রূপের ভাস্কর্য দেখতে পাওয়া যায়।

তান্ত্রিক শিব ("शिव") ঐতিহ্য শিব সম্পর্কিত পুরাণ ও পৌরাণিক কাহিনিগুলোকে উপেক্ষা করে এবং উপশাখা অনুসারে বিভিন্ন সাধনা পদ্ধতি গড়ে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, ঐতিহাসিক নথিতে পাওয়া যায় যে তান্ত্রিক কাপালিকরা (অর্থাৎ 'খুলি-ধারী ব্যক্তি') বজ্রযান বৌদ্ধদের সাথে সহাবস্থান করত এবং অনেক বৌদ্ধ আচার ভাগাভাগি করত। তারা গুপ্ত সাধনায় শিব ও শক্তিকে পূজা করত, মাথার খুলির মালা পরত, ফাঁকা খুলিতে ভিক্ষা করত এবং কখনো কখনো মাংসকে আচার অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে ব্যবহার করত। এর বিপরীতে, কাশ্মীর শৈবধর্মের গুপ্ত ঐতিহ্যে ক্রম এবং ত্রিকা উপশাখাগুলি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ক্রম উপশাখা শিব ও কালী জুটিকে কেন্দ্র করে গুপ্ত সাধনায় মনোযোগ দিত। ত্রিকা উপশাখা শিবকে কেন্দ্র করে ত্রৈতক ধর্মতত্ত্ব গড়ে তোলে এবং একাধারে কঠোর তপস্যার জীবনধারা গ্রহণ করে আত্মিক মুক্তির জন্য শিবের সাথে একত্বের সাধনা করত।

বৈষ্ণবধর্ম

বৈষ্ণব (বিষ্ণু-কেন্দ্রিক) সাহিত্যে শিবকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন শৈব সাহিত্য শিবকে সর্বোচ্চ সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করে, তেমনি বৈষ্ণব সাহিত্য বিষ্ণুকে সর্বোচ্চ সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করে। তবে, উভয় ঐতিহ্যই বহুমুখী এবং শিব ও বিষ্ণু (এবং দেবী)-কে শ্রদ্ধা করে। তাদের গ্রন্থগুলো একপাক্ষিকতার পরিচয় দেয় না এবং বৈষ্ণব গ্রন্থ যেমন ভাগবত পুরাণ  কৃষ্ণকে চূড়ান্ত বাস্তবতা হিসেবে বন্দনা করা হয়েছে এবং শিব ও শক্তিকেও ব্যক্তিগত রূপে সেই একই চূড়ান্ত বাস্তবতার সমতুল্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। শৈব ধর্মের গ্রন্থগুলোও একইভাবে বিষ্ণুকে বন্দনা করে। উদাহরণস্বরূপ, স্কন্দ পুরাণ বলে:

বিষ্ণু অন্য কেউ নন, তিনিই শিব, এবং যাকে শিব বলা হয়, তিনি বিষ্ণুরই সমান।

স্কন্দ পুরাণ, ১.৮.২০–২১

উভয় ঐতিহ্যেই এমন কাহিনি রয়েছে যেখানে কে শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে—যেখানে শিব বিষ্ণুকে সম্মান জানাচ্ছেন এবং বিষ্ণু শিবকে সম্মান জানাচ্ছেন। তবে, উভয়ের সাহিত্য ও শিল্পকর্মে এই পারস্পরিক অভিবাদন আসলে তাদের পরিপূরক সম্পর্কের প্রতীক। মহাভারত ঘোষণা করে যে অপরিবর্তনীয় চূড়ান্ত বাস্তবতা (ব্রহ্ম) শিব এবং বিষ্ণু উভয়ের সাথে অভিন্ন; যে বিষ্ণু শিবের সর্বোচ্চ প্রকাশ এবং শিব হলেন বিষ্ণুর সর্বোচ্চ প্রকাশ।

শাক্তবাদ

হিন্দুধর্মের দেবীমুখী শক্তি পরম্পরা এই ধারণার উপর ভিত্তি করে যে ব্রহ্মনামক পরম নীতি এবং চূড়ান্ত বাস্তবতা হল নারীমূর্তি, তবে এটি পুরুষকে তার সমান এবং পরিপূরক সঙ্গী হিসাবে বিবেচনা করে। এই সঙ্গী হলেন শিব।

নারীত্বের প্রতি শ্রদ্ধার পরম্পরার প্রাচীনতম প্রমাণ রুদ্র-শিব প্রসঙ্গে পাওয়া যায় এবং তা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদের দেবী সূক্ত নামে পরিচিত এক স্তোত্রে পাওয়া যায়।

শাক্তবাদের ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেবী উপনিষদে শিবের উল্লেখ এবং প্রশংসা করা হয়েছে, যেমন এর ১৯ নম্বর শ্লোকে। শাক্তবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ দেবী মাহাত্ম্য-তেও শিবকে বিষ্ণুর পাশাপাশি পূজনীয় দেবতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা এই পরম্পরায় ভগবদ গীতার সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। অর্ধনারীশ্বর ধারণা দেবতা শিব এবং দেবী শক্তিকে একসঙ্গে উপস্থাপন করে, যা অর্ধেক পুরুষ এবং অর্ধেক নারী রূপে প্রকাশিত একটি প্রতিমূর্তি এবং এই সংযুক্তির থিমটি বহু হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ও মন্দিরে পাওয়া যায়।

স্মার্ত পরম্পরা

হিন্দুধর্মের স্মার্ত পরম্পরায় শিব পঞ্চায়তন পূজার একটি অংশ। এই প্রথায় পাঁচটি দেবতার মূর্তি বা বিমূর্ত প্রতীক ব্যবহার করা হয়, যাদের সমান বলে বিবেচনা করা হয় এবং যাদের পঞ্চকোণাকৃতি বিন্যাসে স্থাপন করা হয়। শিব হলেন এই পাঁচ দেবতার একজন, অন্যরা হলেন বিষ্ণু, দেবী (যেমন পার্বতী), সূর্য এবং গণেশ বা স্কন্দ বা ভক্তের পছন্দ অনুযায়ী যে কোনো ব্যক্তিগত ইষ্টদেবতা।

দার্শনিকভাবে, স্মার্ত পরম্পরা জোর দেয় যে সমস্ত মূর্তি (মূর্তি) হল ব্রহ্মনের বিভিন্ন দিককে কল্পনা ও মনোনিবেশ করার জন্য প্রতীকী মাধ্যম, স্বতন্ত্র সত্তা নয়। এই প্রথার চূড়ান্ত লক্ষ্য হল মূর্তির ব্যবহার অতিক্রম করে মূর্তির মাধ্যমে প্রতীকায়িত চিরন্তন সত্যকে উপলব্ধি করা এবং আত্মা ও ব্রহ্মনের অদ্বৈত সত্তা উপলব্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া। আদি শঙ্করাচার্য দ্বারা জনপ্রিয়কৃত এই পঞ্চায়তন মণ্ডল এবং মন্দিরগুলির অনেকগুলি গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ের এবং রাজস্থানের আজমের থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে নন্দ গ্রাম থেকে প্রাপ্ত একটি পঞ্চায়তন সেট কুষাণ সাম্রাজ্যের যুগের (খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর পূর্বের) বলে চিহ্নিত হয়েছে। এই কুষাণ যুগের সেটে শিব, বিষ্ণু, সূর্য, ব্রহ্মা এবং এক অজানা দেবতার মূর্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

যোগ

শিবকে মহান যোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারণ তিনি সম্পূর্ণরূপে নিজস্ব আত্মসত্তায় - পরম বাস্তবতায় - নিমগ্ন। তিনি যোগীদের প্রভু এবং ঋষিদের জন্য যোগের আচার্য। স্টেলা ক্রামরিশের মতে, দক্ষিণামূর্তি রূপে শিব হলেন সর্বোচ্চ গুরু, যিনি "নীরবতায় একজনের অন্তর্গত আত্মা (আত্মা) এবং চূড়ান্ত বাস্তবতা (ব্রহ্মন)-এর একাত্মতার শিক্ষা দেন।" শিব হলেন সংহার ( संहार) বা বিলয়ের প্রতীক, যা মায়ার বিলয়ের মাধ্যমে মানব দুঃখ-কষ্টের সীমা অতিক্রম করার ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই কারণেই শিবকে যোগের সাথে সম্পর্কিত বলে বিবেচনা করা হয়।

যোগের তত্ত্ব এবং চর্চা, বিভিন্ন শৈলীতে, হিন্দুধর্মের সমস্ত প্রধান পরম্পরার একটি অংশ, এবং শিব বহু হিন্দু যোগগ্রন্থে পৃষ্ঠপোষক বা মুখপাত্র হিসেবে স্থান পেয়েছেন। এই গ্রন্থগুলিতে যোগের দর্শন এবং প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে। ধারণা করা হয় যে এই ধারণাগুলি প্রথম সহস্রাব্দ খ্রিস্টাব্দের শেষ শতাব্দী বা তার পরবর্তী সময়ের, এবং এগুলি ঈশ্বর গীতা (শাব্দিক অর্থে 'শিবের গান') এর মতো যোগগ্রন্থ হিসেবে টিকে আছে। হিন্দুধর্ম এবং ভারতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু নিকোলসনের মতে, এই গ্রন্থগুলি "হিন্দুধর্মের বিকাশে গভীর এবং স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।"

অন্য বিখ্যাত শিব সম্পর্কিত গ্রন্থগুলি হঠযোগকে প্রভাবিত করেছে, অদ্বৈত বেদান্তের একত্ববাদী ধারণাগুলিকে যোগ দর্শনের সাথে একীভূত করেছে এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের তাত্ত্বিক বিকাশকে অনুপ্রাণিত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে শিবসূত্র, শিবসংহিতা এবং দশম শতাব্দীর কাশ্মীর শৈববাদের পণ্ডিত অভিনবগুপ্তের রচনাগুলি। অভিনবগুপ্ত শিব এবং যোগ সম্পর্কিত ধারণার প্রাসঙ্গিকতার বিষয়ে তাঁর বিশ্লেষণে লেখেন যে "মানুষ সাধারণত তাদের নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থাকে এবং অন্যের জন্য কিছু করে না," এবং শিব ও যোগের আধ্যাত্মিকতা ব্যক্তিকে এর ঊর্ধ্বে উঠতে সাহায্য করে, আন্তঃসম্পর্ক বোঝাতে সহায়তা করে এবং এর ফলে ব্যক্তি এবং সমগ্র বিশ্বের জন্য আরও আনন্দময় অস্তিত্বের দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করে।

ত্রিমূর্তি

ত্রিমূর্তি হলো হিন্দুধর্মের একটি ধারণা, যেখানে সৃষ্টির, রক্ষার এবং বিনাশের মহাজাগতিক কার্যাবলী যথাক্রমে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, রক্ষাকর্তা বা সংরক্ষণকারী বিষ্ণু এবং বিনাশকারী বা রূপান্তরকারী শিবের রূপে ব্যক্ত হয়েছে। এই তিন দেবতাকে "হিন্দু ত্রয়ী" বা "মহা ত্রিমূর্তি" বলা হয়। তবে, হিন্দুধর্মের প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় গ্রন্থগুলিতে বহু দেবদেবীর ত্রয়ী পাওয়া যায়, যার মধ্যে কিছুতে শিবের অন্তর্ভুক্তি নেই।

গুণাবলী

  • তৃতীয় চক্ষু: শিবকে প্রায়শই তৃতীয় চোখসহ চিত্রিত করা হয়, যার দ্বারা তিনি কাম বা বাসনাকে ভস্ম করেছিলেন। এই কারণে তাকে "ত্র্যম্বকম" (त्र्यम्बकम्) বলা হয়। ধ্রুপদী সংস্কৃতে "অম্বক" শব্দটি "চক্ষু" অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং মহাভারতে শিবকে ত্রিনয়ন বা তিন চোখযুক্ত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, তাই এই নামটির অর্থ প্রায়ই "তিন চোখযুক্ত" হিসেবে অনুবাদ করা হয়। তবে বৈদিক সংস্কৃতে "অম্বা" বা "অম্বিকা" শব্দটি "মাতা" বোঝায় এবং এই প্রাথমিক অর্থ অনুসারে নামটির অনুবাদ করা হয়েছে "তিন মাতাদের অধিকারী"। এই তিন মাতৃদেবী সম্মিলিতভাবে "অম্বিকা" নামে পরিচিত। কিছু সম্পর্কিত অনুবাদ এমন ধারণার উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে যে এই নামটি আসলে রুদ্রকে দেওয়া হোমের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত আহুতির সাথে সম্পর্কিত, যা কিছু প্রথা অনুযায়ী দেবী অম্বিকার সাথে ভাগ করা হতো।
  • চন্দ্রকলার চন্দ্র: শিবের মস্তকে চন্দ্রকলার চন্দ্র বিরাজমান। এই বৈশিষ্ট্যটির জন্য তাকে চন্দ্রশেখর (चन्द्रशेखर, "যার শিরে চন্দ্র বিরাজমান" – চন্দ্র = "চাঁদ"; শেখর = "শিরোভূষণ, মুকুট") নামে অভিহিত করা হয়। শিবের মস্তকে চন্দ্রের অবস্থান তার প্রতিমা চিত্রণের একটি প্রথাগত বৈশিষ্ট্য এবং রুদ্র প্রধান দেবতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করে রুদ্র-শিব রূপে পরিচিত হন। এই সম্পর্কের উৎপত্তি সম্ভবত চাঁদকে সোমের সাথে অভিন্ন হিসেবে চিহ্নিত করার কারণে হতে পারে, এবং ঋগ্বেদে এমন একটি স্তোত্র রয়েছে যেখানে সোম এবং রুদ্রকে একসঙ্গে আহ্বান করা হয়েছে। পরবর্তী সাহিত্যে সোম এবং রুদ্রকে একে অপরের সাথে অভিন্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, যেমনটি সোম এবং চাঁদের ক্ষেত্রেও হয়েছে।
  • ভস্ম: শিবের প্রতিমা চিত্রণে তার শরীর ভস্ম (ভস্মা, বিভূতি) দ্বারা আচ্ছাদিত দেখা যায়। ভস্ম এই সত্যের প্রতীক যে সমস্ত ভৌত অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী, যা পরিণামে ভস্মে পরিণত হয়। এটি আত্মার চিরন্তন স্বরূপ ও আধ্যাত্মিক মুক্তির সাধনার গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
  • জটাজুট: শিবের বৈশিষ্ট্যমূলক কেশশৈলী "জটিন" (যার জটাজুট রয়েছে) এবং "কপার্দিন" (যার কেশ শঙ্খের আকৃতিতে বিন্যস্ত বা বেণী করা) উপাধিতে প্রকাশ পেয়েছে। "কপার্দ" বলতে বোঝায় একটি শঙ্খ বা ঝিনুকের আকৃতির বেণী বা সাধারণভাবে, এলোমেলো বা কোঁকড়ানো চুল।
  • নীলকণ্ঠ: শিবকে নীলকণ্ঠ নামে অভিহিত করা হয়। সমুদ্র মন্থনের সময় উৎপন্ন হলাহল বিষের বিধ্বংসী শক্তি নষ্ট করার জন্য শিব সেই বিষ পান করেছিলেন। তার এই কার্যকলাপে বিস্মিত হয়ে পার্বতী তার গলা চেপে ধরেন, যাতে বিষটি তার পাকস্থলীতে পৌঁছে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। তবে বিষের প্রভাব এতটাই শক্তিশালী ছিল যে এটি তার গলার রং নীল করে দেয়। এই বৈশিষ্ট্যটি নির্দেশ করে যে মানুষ শিবের মতো হতে পারে, যদি সে সমানভাবে ধৈর্য ও শান্তি সহকারে পার্থিব অবমাননা ও অপমানকে সহ্য করে এবং অপমানকারীদের আশীর্বাদ করে।
  • ধ্যানমগ্ন যোগী: শিবের প্রতিমা চিত্রণে প্রায়ই তাকে যোগাসনে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেখানো হয়, কখনো কখনো প্রতীকী হিমালয়ের কৈলাস পর্বতের উপর তিনি যোগের অধিপতি রূপে অধিষ্ঠিত থাকেন।
  • পবিত্র গঙ্গা: শিবকে গঙ্গাধর নামে অভিহিত করা হয়, যার অর্থ "যিনি গঙ্গা নদীকে ধারণ করেন"। গঙ্গা শিবের জটাজুট থেকে প্রবাহিত হয়। যা দেশের প্রধান নদীগুলির মধ্যে অন্যতম, গঙ্গাকে বলা হয় যে তিনি শিবের কেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।
  • বাঘের চামড়া: শিবকে প্রায়ই বাঘের চামড়ার উপর আসীন অবস্থায় চিত্রিত করা হয়।
  • বাসুকি: শিবকে প্রায়ই সাপ বাসুকিকে মালারূপে ধারণ করতে দেখা যায়। বাসুকি হল নাগদের দ্বিতীয় রাজা (প্রথম রাজা হলেন বিষ্ণুর বাহন শेष)। এক কাহিনি অনুযায়ী, সমুদ্র মন্থনের পর শিব বাসুকিকে আশীর্বাদ করেন এবং অলংকার হিসেবে ধারণ করেন।
  • ত্রিশূল: শিব সাধারণত একটি ত্রিশূল ধারণ করেন। ত্রিশূল বিভিন্ন হিন্দু গ্রন্থে অস্ত্র বা প্রতীক হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। প্রতীকের দিক থেকে ত্রিশূল শিবের তিনটি দিক—"স্রষ্টা, রক্ষক এবং বিনাশকারী" বোঝায়। অথবা এটি তিনটি গুণ—সত্ত্ব (পবিত্রতা), রজঃ (উত্সাহ), এবং তমঃ (অজ্ঞানতা)-এর ভারসাম্যকেও নির্দেশ করে।
  • ডমরু: ঘণ্টা আকৃতির ছোট ঢোলকে ডমরু বলা হয়। এটি নৃত্যরত শিবের বিখ্যাত রূপ নটরাজে দেখা যায়। শিবের এক বিশেষ হস্তমুদ্রা "ডমরু-হস্ত" (অর্থাৎ "ডমরু ধারণকারী হাত") নামে পরিচিত, যা এই ঢোলটি ধরতে ব্যবহৃত হয়। এই ঢোলটি বিশেষভাবে কাপালিক সম্প্রদায়ের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
  • ফরশা (পরশু) এবং হরিণ: ওড়িশা এবং দক্ষিণ ভারতের শিবের মূর্তিতে তাকে হাতে ফরশা (পরশু) এবং হরিণ ধারণ করতে দেখা যায়।
  • রুদ্রাক্ষের মালা: শিব সাধারণত রুদ্রাক্ষের মালা ধারণ করেন বা ডান হাতে ধারণ করেন। এটি করুণা, সন্ন্যাস জীবন এবং ধ্যানের প্রতীক।
  • নন্দী: নন্দী শিবের বাহন হিসেবে পরিচিত। গবাদি পশুর সাথে শিবের সম্পর্ক তার উপাধি পশুপতি বা পশুপতি (पशुपति)-এর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। শর্মা এটিকে "গবাদি পশুর অধিপতি" এবং ক্রামরিশ এটিকে "প্রাণীদের অধিপতি" হিসেবে অনুবাদ করেছেন। এই উপাধি বিশেষত রুদ্রের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।
  • কৈলাস পর্বত: হিমালয়ে অবস্থিত কৈলাস পর্বত শিবের ঐতিহ্যবাহী বাসস্থান। হিন্দু পুরাণে কৈলাস পর্বতকে লিঙ্গের আকৃতির বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং মহাবিশ্বের কেন্দ্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
  • গণ: গণেরা শিবের সেবক এবং কৈলাসে বসবাস করে। তাদের প্রকৃতির কারণে প্রায়ই "ভূতগণ" বা ভূতের দল নামে অভিহিত করা হয়। সাধারণত তারা সদয়, তবে যদি কেউ তাদের প্রভুর বিরুদ্ধে অন্যায় করে, তখন তারা রুষ্ট হয়। ভক্তদের পক্ষে শিবের কাছে মধ্যস্থতা করার জন্য তাদের আহ্বান করা হয়। শিব তার পুত্র গণেশকে তাদের নেতা হিসেবে মনোনীত করেন, তাই গণেশের উপাধি হলো "গণেশ" বা "গণপতি", যার অর্থ "গণদের অধিপতি"।
  • বারাণসী: বারাণসী (বেনারস) শিবের প্রিয় নগরী হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি ভারতের অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান। ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে এটি "কাশী" নামে পরিচিত।

মন্তব্যসমূহ